কীভাবে পানামা খাল ধ্বংস ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাবে | Panama Canal In Bengali
পানামা খাল বা পানামা যোজক বর্তমান শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ট আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের ফলে বিশ্ব বাণিজ্য অনেক সহজ ও সরল সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দুপাশের সমুদ্রের প্রায় দেড়শ খানা জাহাজ তারা এই পানামা খাল দিয়ে যাতায়াত করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলাবাহুল্য এই পারাপারের জন্য জাহাজগুলি চার লাখ ডলার পর্যন্ত খরচ দিয়ে থাকে পানামা খাল সংস্থাকে।
কিন্তু বর্তমান সমস্যা হল পানামা খালটিতে কোনরকম সমস্যা না থাকলেও কর্তৃপক্ষ এই জাহাজগুলোকে কোনভাবেই পানামা খালে প্রবেশ করতে দিতে চায় না। অত্যাধুনিক এই যোজক দিয়ে কেন জাহাজ চলাচল করতে কর্তৃপক্ষ বাধার দান করছে তাই আজ আমরা আলোচনা করব -
সমগ্র পৃথিবীতে বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুটি খাল বা যোজক অত্যন্ত অপরিহার্য একটি হলো আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যবর্তী সুয়েজ কানাল বা সুয়েজ খাল এবং অন্যটি উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগকারী এবং প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের সংযোগকারী এই পানামা খাল।
সমগ্র বিশ্বের প্রায়ই ৫০ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ এই দুটি খাল বা সংক্ষেপ রাস্তাকে ব্যবহার করে থাকে। ২০২১ সালে এভারগ্রিন নামে একটি জাহাজ সুয়েজ খালে আটকে গেলে সমগ্র বিশ্ব বাণিজ্যের চরম অবনতির স্বীকার হতে হয় পরবর্তী ছয় দিনের জন্য।
যদি কোনভাবে এই দুটি খাল বন্ধ হয়ে যায় তবে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রচুর পরিমাণ লভ্যাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হবে সাথে সাথে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি ও রপ্তানি করা মালগুলি অনেক রাস্তা ঘুরে অন্য দেশে পৌঁছাতে হবে এর ফলে সময় ও অর্থ দুই ব্যাপকভাবে ব্যবসার উপর প্রভাব বিস্তার করবে। বিষয়টিকে আরেকটু পরিষ্কার করে বুঝে নেওয়া যাক।
ধরা যাক কোন একটি পণ্যবাহী জাহাজ ইউনাইটেড কিংডম থেকে উত্তর আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো তে পৌঁছাবে। এই যাত্রা পথের জন্য জাহাজটি দুভাবে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে, প্রথমত জাহাজটিকে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের কিনারা ধরে উত্তর আমেরিকার সানফ্লাসিসকো তে পৌঁছাতে হবে। সুতরাং জাহাজটিকে প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে। আর এর জন্য সময় লাগবে প্রায় 28 দিনের মতো আর প্রয়োজন হবে ৮০ লাখ লিটার তেলের। যার মোট খরচ প্রায় ২৬০ কোটি টাকা।
জাহাজটি দ্বিতীয়তঃ যে রাস্তা ধরে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে সেটি হল উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের পাশ দিয়ে সুয়েজ ক্যানাল দিয়ে প্রবেশ করে প্রশান্ত মহাসাগর ধরে সান ফ্রান্সিস্কতে পৌঁছানো। এই পথ দিয়ে পৌঁছানোর ফলে জাহাজটির মাত্র ১৪ হাজার কিলোমিটার যাত্রাপথ পাড়ি দিতে হবে। সুতরাং যাত্রাপথ প্রায় অর্ধেক কমে যাওয়ার ফলে মোট খরচ অর্ধেক হবে।
হয়তো এখন আমরা আন্দাজ করতে পারছি যে এই কারণেই এই সকল জাহাজগুলি পানামা খাল কে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু আমরা যদি অনুমান করি শুধুমাত্র খরচ কমানোর উদ্দেশ্যেই এই সকল জাহাজগুলি পানামা যোজক ব্যবহার করে তবে তা আমাদের ভুল সিদ্ধান্ত হবে কারণ জাহাজগুলি পানামা যোজক দিয়ে যাওয়ার জন্য এই খাল কর্তৃপক্ষ চার লাখ থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত ট্যাক্স হিসাবে ধার্য করে। সুতরাং এই পথ দিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ গুলির যে অর্থ খুব কম পরিমাণে ব্যয় হয় তা কখনোই নয়।
বিদেশি এই জাহাজ গুলির পানামা খাল ব্যবহার করার মূল যে উদ্দেশ্য তা হল মোট অতিক্রান্ত দিনকে কমিয়ে নিয়ে আসা এর ফলে সমগ্র বিশ্বে যে জাহাজগুলি দশবার পৌঁছাতে পারে সেখানে এই সময় কম ব্যবহার হওয়ার ফলে ওই একই পথে জাহাজটি ১৫ থেকে ১৮ বার যাতায়াত করতে পারবে। এই কারণের জন্যই শিপিং কোম্পানিগুলি এত টাকা খরচ করে পানামা খাল কে ব্যবহার করে। যার কারণ হলো যত সময় কম ব্যবহার করা যাবে সেই সময়ই পরবর্তী শিপিং এর জন্য জাহাজগুলিকে ব্যবহার করতে পারা।
কিন্তু এই পথ দিয়ে জাহাজ গুলোকে পারাপার হতে গেলে কখনো কখনো পাঁচ থেকে দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এর ফলে জাহাজ গুলির সময় বাঁচানোর স্থানে সময় বেশি ব্যাবহার হয়। তবে এখানে আমাদের একটু জেনে নেওয়া দরকার পানামা খাল কিভাবে এই জাহাজ পারাপারের কাজ করে।
পানামা খাল কিভাবে জাহাজ পারাপার করে
দুই আমেরিকার মধ্যবর্তী এই স্থানটির দৈর্ঘ্য তিরিশ কিলোমিটার। আর এই স্থানের দুইপাশে একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর অন্য দিকে আটলান্টিক মহাসাগর। আর এই তিরিশ কিমি জায়গাটা সমুদ্র থেকে তিরিশ মিটার পর্যন্ত উচু। এর ফলে সুয়েজ খালের মতো খাল খনন করাও অসম্ভব। এই কারণে পানামা খালের গঠনগত কার্যকারিতা আলাদা। বলা যেতে পারে বেশ খানিকটা মজাদার বিষয়টা।
পানামার এই স্থানটির মধ্যে একটি হ্রদ আছে, - যার নাম গাটুন লেক । যার উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে 30 মিটার পর্যন্ত আর এই হ্রদের জলকে কাজে লাগিয়ে পানামা খালের এক দিকের জাহাজকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সমগ্র পথ টির মধ্যে অনেকগুলি লক গেট আছে যেগুলিকে ব্যবহার করে জলের তলকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জাহাজকে একটি লক গেট থেকে অন্য লগ গেটে পৌঁছানো হয়। এইভাবে পরপর তিনটি লক গেট পার করে জাহাজকে পৌঁছাতে হয় মধ্যবর্তী গাটুন লেকে।
সুতরাং প্রতিবারই জাহাজ যাতায়াতের জন্য ব্যবহার হয় এই রদের জল। হ্রদটির জলের উৎস একমাত্র বৃষ্টি যে কারণে এই মিষ্টি জল পানামার অধিকাংশ লোকজন বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে এমনকি তাদের দৈনিক কাজেও এই হ্রদের জল ব্যবহৃত হয়। জাহাজ পারাপারের জন্য এই হ্রদের জল ব্যবহার করার ফলে মিষ্টি জল সাগরের জলে মিশ্রিত হয়ে তা অব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে এর ফলে হ্রদের জল ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।
শুধু একটা মাত্র জাহাজ যাওয়ার জন্য গেটন লেকের জল এত পরিমাণ খরচ হয় যা ৫ লক্ষ মানুষ ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং প্রতিদিন এরকম 38 টি জাহাজ পারাপার করার ফলে এক কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের ব্যবহারযোগ্য জল অপচয় হয়। সাধারণত আশেপাশের এলাকার বৃষ্টি থেকে এই মিষ্টি জলের সৃষ্টি হয়। কিন্তু জাহাজ পারাপারের জন্য অধিকাংশ জল এভাবে নষ্ট হয়। Rocky Aur Rani Ki Prem Kahani
কেনো পানামা খাল বন্ধ হবে
যেহেতু পানামা দেশের অধিকাংশ লোক এই রদের জলের উপরে নির্ভরশীল তাই এই রধের জলস্তর কমে যাওয়ার ফলে দেশে জলের আশঙ্কা দেখা দিতে শুরু করেছে। যদি কোন বছর বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে কম হয় তবে এই জলের অনটন আরো বেশি পরিমাণে দেখা দেয়। যেমন ২০২৩ সালে পানামা অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার জন্য এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
বিগত শতাব্দীতে যখন পানামা খালটি খনন করা হয় তখন এই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে আজ এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পানামা দেশকে। এখন পানামার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে - হয় তাদের এই খালের মাধ্যমে জাহাজকে একইভাবে পারাপার করতে হবে এবং তা থেকে যে মূলধন আসে তাকে ব্যবহার করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে।
পানামার সামনে এই সমস্যার সমাধানের রাস্তাটি ও খুব সহজ নয়। কারণ জাহাজ পারাপারের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জিত হয় তা পানামা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় অর্ধাংশ সুতরাং জাহাজ পারাপার বন্ধ হয়ে গেলে অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়বে পানামা। আবার যদি জাহাজ পারাপার যথারীতি চালু থাকে তবে পানীয় জলের অভাব দেখা দেবে আগামী কয়েক দশকে।
এমতাবস্থায় আমরা ভাবতে পারি সমুদ্রের জল যদি পাম দিয়ে গেটন লেকে তুলে দেওয়া হয় তবে সমস্যার সমাধান করা খুব সহজেই সম্ভব। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বড় মুশকিল হল গ্যাট অন লেকের জল মিষ্টি জল আর সমুদ্রের নোনা জল লেখে তুললে লেকের সমস্ত জল তখন নোনা হয়ে অবহারযোগ্য হয়ে উঠবে যার ফলে এই কাজটিও সম্ভব নয়।
পানামা সরকার এই সমস্যার সমাধানে প্রতিদিন যেখানে ৩৮ টি জাহাজ পারাপার হতো সেখানে বর্তমানে মাত্র 18 টি করে জাহাজ প্রতিদিন পার করে। শুধু তাই নয় যে সমস্ত কার্গো জাহাজ গুলির পণ্য অন্য সকল জাহাজের থেকে কম শুধুমাত্র তাদেরকেই এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
এই কারণে বর্তমানে প্রায় প্রতিদিন পানামা খালের দুপাশে 100 থেকে দেড়শ খানা জাহাজ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র তাদের পারাপারের সময় আসার জন্য। পানামা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আগের থেকে অনেক সচেতন হয়ে উঠেছে কিভাবে দেশের প্রয়োজনীয় ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণ ঠিক রেখে খালটিকে সচল করে রাখা যায়।
যদি পানামা খালটি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় তবে সে ক্ষেত্রে অন্য রাস্তা কে বেছে নিতে হবে। তবে তেমন কোন ইনকাম সোর্স পানামা দেশের বর্তমানে নেই যার মাধ্যমে পানামা খাল বন্ধ হয়ে গেলেও অর্থনৈতিক ভীত সুদৃঢ় হবে। সুতরাং এই সমস্যার সমাধানের অন্য পথ বেছে নেওয়া বুদ্ধিমান এর কাজ।
Comments 0
EmoticonEmoticon